জেলিফিশ

জেলি ফিশ সম্পর্কে কিছু কথা।
জেলি ফিস গুলো  অবশ্য মৎসজীবীরা সমুদ্রতীরেই ফলে দেন।
প্রানীবিজ্ঞানের নিরিখে জেলি ফিশ নিডারিয়া পর্বের প্রাণী।হাইড্রা,সাগরকুসুম আর প্রবাল এদের আত্মীয়।অত্যন্ত অনুন্নত ধরনের প্রাণী বলে এদের চেহারা কেমন যেন কিম্ভূত।একটি ছাতা থেকে বাঁটটিকে খুলে ফেললে যেরকম দেখায়,এদের আকৃতি তেমনি।বাইরেরটা উত্তল আর ভিতরেরটা অবতল।কোন জাতির জেলি ফিসের আকার উল্টানো বাটির মত আর কোনটা ঠিক ঘন্টার মত।
জেলি ফিশ বহুকোষী প্রানী।তবে উন্নত প্রানীর মত এদের এত অঙ্গপ্রতঙ্গ নেই।ছাতা বা বাটির কিনারা দিয়ে বেরিয়ে আসে অনেক সরু করষিকা বা টেনট্যাকল।তলার অবতল দিকটার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে চতুষ্কোণ মুখ।মুখের চার কোনে থাকে চারটি বাহু।
মাঝারি আকারের জেলি ফিশ অরেলিয়া'র শরীরটা প্রায় স্বচ্ছ।এইজন্য প্রানীটির শরীরের ভিতরটা স্পষ্টতই দেখা যায়।মুখটি বসানো থাকে ছোট্ট একটি বৃন্তের উপর।মুখের পরেই এদের পাকস্থলী বা গ্যাস্ট্রিক পাউচ।এর গা থেকে বেরিয়েছে অন্যান্য এক নালিকা তন্ত্র (ক্যানাল সিস্টেম)।এই নালিকা গুলোই ক্রমাগত শাখা-প্রশাখায়  ভাগ হয়ে ছরিয়ে পরেছে সারা শরীরে।
মাংসাশী জেলি ফিসের খাদ্য হজম হয়ে থাকে পাকস্থলীতে।খাদ্যের সারাংশ এরপর নালিকা তন্ত্রের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে শরীরের সব স্থানে।
অক্সিজেন সংবহনের কাজটিও করে ঐ নালিকা তন্ত্র।অক্সিজেন টেনে নেবার জন্য কোন ফুলকার মত কোন অঙ্গপ্রতঙ্গ নেই।তাই এগুলো নিজের সমস্ত শরীর দিয়েই প্রয়োজনীয় অক্সিজেন টুকু নেয়।
এদের শিকার ধরার কৌশলটিতে রয়েছে নিজস্বতা।যা কেবল মাত্র নিডারিয়া পর্বের প্রাণীদেরই রয়েছে।জেলি ফিসের আত্মীয়,হাইড্রা সাগরকুসুম,প্রবাল ,পর্তুগীজ-ম্যান-অব-ওয়ার,পরপিটা,ভেলেলা এর শিকার করার পদ্ধতিও কিছু টা একই রকম।জেলি ফিশের শরীরের সর্বত্র,বিশেষ করে বাহুতে অসংখ্য আণুবীক্ষণিক 'নিডোব্লাস্ট' কোষ রয়েছে।এই কোষ গুলোই এদের প্রধান অস্ত্র।কোষ ফাঁপা।
এই অংশই থাকে বিষাক্ত তরলে পরিপূর্ণ।

    জেলি ফিশ কুলে দৈত্য আর বামন।
জেলি ফিশত আর এক জাতের প্রাণী নয়,কাজেই
এদের আকার আয়তনে বৈচিত্র্য ও প্রচুর।কোন জেলি ফিশ আকারে ছোটই, একটা মাঝারি মাপের শিশির মধ্যে এঁটে যায়।অনেক জাতের জেলি ফিশ আবার এতই বড় যে, প্রমাণ সাইজের বেলচা ছাড়া এদের তোলাই সম্ভব হয় না।আজ পর্যন্ত যত জাতের জেলি ফিশের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় টির নাম 'আর্কটিক জায়েন্ট জেলি ফিশ।'এর ল্যাটিন নামটাও এর আকারের সঙ্গে বেশ জুতসই -'সায়ানিয়া ক্যাপিলাটা আর্কটিকা'।আটলান্টিক সমুদ্রের উত্তর -পশ্চিম অংশেই এদের দেখা গেছে।এই জাতের একটি জেলি ফিশ ম্যাসাচুসেটস উপসাগরে ধরা পরে ,যার ছাতার মত দেহটির ব্যাস প্রায় সোয়া দুই মিটার।আর বাহু গুলো ছড়ানো আবস্থায় এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছিল ৩৬ মিটার।অন্যদিকে আবার এমন কিছু জেলি ফিশের সন্ধান ও পাওয়া গেছে যাদের ছাতার মত দেহের ব্যাস ২ সেন্টিমিটারের ও কম।
       সবচেয়ে বিষাক্ত জেলি ফিশ
সব জাতের জেলি ফিশই অল্প বিস্তর বিষাক্ত।তবে এব্যাপারে সবচেয়ে কুখ্যাত 'বক্স জেলি ফিশ'।মাঝারি আকারের এই জেলি ফিশের লাতিন নাম 'কিরোনেক্স ফ্লেকেরি'।আর একটি প্রচলিত নামও আছে এর -'অস্ট্রেলিয়ান সি-ওয়াম্প'।নামেই বুঝা যাচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার  কাছাকাছি সমুদ্রেই এর আস্তানা।কতটা বিষাক্ত বক্স জেলি ফিশ?বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা গেছে, কেউটে সাপের বিষের মত শক্তিশালী এদের বিষ।এই প্রাণীর হুল বা কাটা বিধলে এক থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই মৃত্যু অনিবার্য।বক্স জেলি ফিশের আঘাত পাওয়া কোন হতভাগ্য কে এত কম সময়ের মধ্যে হাসপাতালে কিংবা ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না।১৮৮০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড অঞ্চলে সমুদ্রের এই বিপদজনক প্রাণীর বিষে প্রাণ হারিয়েছেন ৬৬ জন।এর বিষের প্রভাবে আক্রান্ত ব্যক্তির হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়।
            
জেলি ফিশের বিষ।
জেলি ফিশের বিষ যে কী মারাত্মক, তা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে।বক্স জেলি ফিশ (কিরোপস্যালমাস) এবং সি-ওয়াম্প (কিরোনেক্স)প্রায় কেউটে সাপের মতোই বিষাক্ত।এদের বিষ নিরোটক্সিক প্রকৃতির।এর প্রভাবে আক্রান্তের শরীরে আরম্ভ হয় প্রচন্ড যন্ত্রনা,অস্বাভাবিক পরিমাণে ঘাম ঝরতে থাকে,স্নায়ুবৈকল্য দেখা দেয়,সময়বিশেষে আক্রান্ত ব্যাক্তি অন্ধ হয়ে যান।সি-ওয়াম্পের হুলে আক্রান্ত এক সাঁতারু কুইন্সল্যান্ডের উপকূলে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে মারা যান।একবার এই বিষকে হাজার ভাগ কম শক্তিশালী করে গবেষণাগারে ইঁদুরের শরীরে ইনজেকশন দেওয়া হয়।ইনজেকশনের সুচ ইঁদুরটির শরীর থেকে বের করে নেওয়ার আগেই সেটি মারা যায়।সি-ওয়াম্পের হুলে মৃত এক ১১ বছরের মেয়ে এবং ৩৮ বছরের বয়স্ক এক ব্যাক্তির শবব্যাবচ্ছেদ করা হয়।দুটি ক্ষেত্রেই মৃতদেহের ফুসফুস এবং শ্বাসনালীতে প্রচুর শ্লেষ্মা দেখা যায়।সমুদ্রবিজ্ঞানী সাউথকট হিসেবে করে দেখেছেন,একটি সি-ওয়াম্পের কর্ষিকার খুব অল্প খনের একটি ছোয়াও  প্রাণঘাতী হতে পারে।বিজ্ঞানি রবার্ট এনডিনের মতে,এই জেলি ফিশের সবচেয়ে ভয়ংকর বিষের মধ্যে একটি।যদিও এর কিছু প্রতিষেধক আছে, কার্যকালে তার উপযোগিতা কিন্তু খুব কমই প্রমানিত হয়েছে।তবে,সি-ওয়াম্পের ছোবল থেকে বাঁচতে বিজ্ঞানিরা মেয়ে দের লম্বা মোজা সবাই কে পড়তে পরামর্শ দিয়েছেন।হুল মোজা ভেদ করতে পারে না-এইটাই একমাত্র আশার কথা।
          জেলি ফিশের রংবাহার
জেলি ফিশের রং কী?এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় এদের কোন নির্দিষ্ট রং নেই।ছোট জাতের কিছু জেলি ফিশ যেমন 'অরেলিয়া' স্বচ্ছ সাদা হলেও জাতবিশেষে এদের রং নীল আর বাদামিতে মেশানো।'সায়ানিয়া' র বিভিন্ন জাতের রংও এক এক রকমের।'রাইজোসোমার'রং দুধের মতো শাদা কিন্তু গম্বুজের মত দেহের কিনারা বরাবর রয়েছে গাঢ় লাল রঙের পট্টি।'পেলাজিয়া নষ্টিলুকা'এবং 'আগ্লান্থা ডিজিটেল'-এর আবার আলোক বিচ্ছুরণ ক্ষমতাও রয়েছে।১ম টিকে উত্তর আটলান্টিকে দেখা যায়, মাঝে মাঝে ইউরোপের উত্তররাঞ্চলেও এরা ভেসে আসে।আগ্লান্থা'র বাস উত্তর মেরুর চারপাশের তুষার শীতল জলে।মেরু অঞ্চল ছেড়ে এরা দক্ষিণদিকে আসেই না।
  
   যে মাছ জেলি ফিশকে ভয় পায় না।
সমুদ্রের প্রায় সকল মাছই জেলি ফিশ, সাগরকুসুম আর প্রবালের মত একনালীদেহী (নিডারিয়া পর্বের )প্রাণীদের সংস্পর্শ এড়িয়ে যেতে চায়।জেলি ফিশের কাটা থেকে যে বিষ বের হয় তাতে ছোট মাছের মৃত্যু অনিবার্য, বড় মাছের শরীরেও এটি অস্বস্তিকর কিছু প্রভাব ফেলে।গবেষণা করে জানা গেছে যে জেলি ফিশের বিষ 'নিরোটক্সিক' প্রকৃতির।এটি শিকারের স্নায়ুতন্ত্রকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়,ফলে প্রাণীটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পরে।
একটি শিকারকে কাবু করতে যতখানি বিষ প্রয়োজন ,ততখানি বিষ অবশ্য জেলি ফিশের নেমাটোসিস্ট কোষ থেকে বের হয় না।প্রথমে জেলি ফিশ তার গুটিকয় কর্ষিকা থেকে শিকারের দিকে নেমাটোসিস্ট সুতো ছুড়ে দেয়।কাঁটা ফুটিয়ে বিষ ঢালা ছাড়াও সেটি শিকারের শরীরে বিষ প্রবেশের একটি উপায়, এবং এগুলো শিকারের শরীরে আটকে যায়।শিকারটি ছাড়া পাবার জন্য যত ছটফট করতে থাকে,ততই আরও কর্ষিকা তার দিকে নেমাটোসিস্ট ছুড়তে থাকে।
নেমাটোসিস্টের বিষাক্ত কাঁটা থেকে সব মাছই যখন দূরে থাকতে চায়,'ক্লাউন ফিশ' তখন অদ্ভুত কৌশলে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।সাগরকুসুমের বড় বড় ট্যানট্যাকলের মধ্যে এরা দিব্যি থাকে।মাছটি (যার ল্যাটিন নাম অ্যাম্ফিপ্রায়ন)সাগরকুসুমের কাছে এসে নিজের শরীর থেকে শ্লেষ্মা বের করতে থাকে।নেমাটোসিস্ট সুতো গুলো এই শ্লেষ্মান্তরেই আটকে যায়।তাছাড়াও বিষের প্রতিষেধক এক প্রাণ রাসায়নিক জৈব পদার্থও রয়েছে এতে।তবে কোন ভাবে এই শ্লেষ্মা ধুয়ে গেলে অবশ্য ক্লাউন ফিশের প্রাণ যায়।সাগরের অন্যান্য মাছেদের মত সাগরকুসুমের বিষে সেও ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।ক্লাউন ফিশ একই কৌশলে জেলি ফিশের বিষাক্ত ছোবলও সহ্য করতে পারে বলে জানা গেছে।কেন এরা জেলি ফিশের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতে চায় ,তাও জানা গেছে।জেলি ফিশের শীকারেও যেমন এরা ভাগ বসাই, তেমনিই জেলি ফিশের কাঁটার ভয়ে অন্য শত্রুও এর কাছে ঘেঁষতে পারে না।অন্য মাছেদের মধ্যে 'হর্স -ম্যাকারেল'(লাতিন নাম ট্রাকিউরাস ট্রাকিউরাস)জেলি ফিশকে ভয় পায় না একেবারেই।ছোট বেলায় এর সম্বেরো জেলি ফিশের (কটিলোরাইজা ববোনিকা )দেহের মধ্যে থাকে।খাবার খুঁজতে আশ্রয় দাতার দেহ থেকে কিছু দূরে গেলেও বিপদের আশঙ্কা রয়েছে দেখলেই এরা চটপট জেলি ফিসের ছাতার মধ্যে ঢুকে পড়ে নির্ভয়ে।
   
  জেলি ফিশ আসলে মাছ নয়।
নামের শেষে ফিশ থাকলেও জেলি ফিশ আসলে মাছ নয়।ইংরেজি নামে শেষে 'ফিশের' লেজ থাকাতেই যত গোলমাল।নামে ফিশ কিন্তু জেলি ফিশ মোটেই ফিশ নয়,বরং মাছের চেয়ে অনেক সরল,অনুন্নত এক ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী এরা।মাঝেমধ্যে জলের টানে মোহনার কম নোনা জলে এরা ভেসে এলেও সমুদ্রের নোনা জলই এদের আসল বিচরণক্ষেত্র।শুধু জেলি ফিশই নয়,'ফিশ' কথাটি নামের সাথে সেঁটে বসলেও 'স্টার ফিশ' আর 'কাটল ফিশও'মোটেই মাছ নয়।প্রথমটি কন্টক-ত্বক বা 'একাইনোডারমাটা'পর্বের,আর দ্বিতীয়টি 'মোলাস্কা'পর্বের প্রাণী।প্রথমটির আত্মীয়দের মধ্যে আছে সমুদ্র-শশা (সি কুকুম্বার) এবং সমুদ্র -শজারু (সি-আরচিন)।দ্বিতীয়টির আত্মীয় অক্টোপাস।
আশা করি আমাদের পোষ্টটি আপনাদের ভালো লেগেছে।এই ধরনের আরও মজার মজার সব তথ্য সংগ্রহের জন্য সব সময়ই সাথে থাকুন Www.Naturelife.Ga
মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়।তাই বন্ধুরা কোন ভুল পেলে বা আপনার নিজের কোন তথ্য জানা থাকলে অবশ্যই Comment করবেন।
বিদায় বন্ধুরা,আবার দেখা হবে।
✴❄
Share This

0 Response to "জেলিফিশ"

Post a Comment

আপনার মন্তব্য জানান